Kali Puja History:কালী পূজা হিন্দু ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব এবং শক্তির দেবী কালীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে কালী পূজা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কালী দেবীর উপাসনা হাজার বছরের পুরনো এবং সময়ের সাথে সাথে এর আচার-অনুষ্ঠান ও জনপ্রিয়তা পরিবর্তিত হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা কালী পূজার ইতিহাস, প্রাচীনকাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত এর বিবর্তন, এবং বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে বিশদে জানবো।
Kali Puja History:কালী পূজার ইতিহাস
কালী দেবীর উপাসনার শিকড় গভীর প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, কালী দেবী হলেন মহাশক্তি এবং সময় ও মৃত্যুর চূড়ান্ত প্রতীক। তিনি শিবের স্ত্রী এবং শিবের শক্তির রূপ হিসেবে পরিচিত। কাল বা সময়ের সাথে দেবী কালীর সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, কারণ তিনি সময়ের ধ্বংসাত্মক দিককে নির্দেশ করেন। পুরাণ অনুসারে, দেবী কালী বিশ্বে অশুভ শক্তির বিনাশ করতে আবির্ভূত হন এবং শিবের শক্তির প্রতীক হিসেবে তাকে পূজা করা হয়।
কালী দেবীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী মহাত্ম্য অংশে। এখানে তাঁকে দেবী দুর্গার ভয়ঙ্কর রূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। দেবী দুর্গার ক্রোধের ফলে কালী আবির্ভূত হন এবং রক্তপিপাসু অসুরদের বিনাশ করেন। কালী দেবীর মুখ, লম্বা জিভ, উগ্র চেহারা এবং রক্তের তৃষ্ণা হিন্দু ধর্মে তাঁর ভয়ঙ্কর রূপের প্রতীক। তিনি ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টির পথ প্রসারিত করেন এবং এই কারণে তাঁকে শক্তির চূড়ান্ত প্রতীক হিসেবে মানা হয়।
মধ্যযুগে কালী পূজার উত্থান
মধ্যযুগে কালী পূজা বিশেষত বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। এই সময়ে, বাংলায় শাক্ত উপাসনা প্রচলিত ছিল এবং শক্তির দেবী হিসেবে কালী পূজার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। মধ্যযুগীয় বাংলার রাজারা এবং সমাজের উচ্চস্তরের মানুষরা কালী পূজার প্রচলন বাড়াতে সাহায্য করেন। বিশেষ করে ১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে কালী পূজা বাংলার রাজবাড়ি ও ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এ সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে কালী মন্দির গড়ে উঠতে থাকে, যেমন কালীঘাট মন্দির এবং দক্ষিণেশ্বর মন্দির। কলকাতার কালীঘাট মন্দির অন্যতম প্রাচীন এবং বিখ্যাত কালী মন্দিরগুলোর একটি, যেখানে দেবী কালীর পূজা করা হয়। এই মন্দিরগুলি কালী পূজার ঐতিহ্য ও প্রভাবকে আরো প্রসারিত করে।
কালী পূজার আধুনিক ইতিহাস: নবকৃষ্ণ দেব ও শোভাবাজার রাজবাড়ি
কালী পূজার আধুনিক প্রচলন অনেকাংশে প্রভাবিত হয়েছিল নবকৃষ্ণ দেবের মাধ্যমে। ১৭৫৭ সালে প্লাসির যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার উপর বিজয় লাভ করে। এই বিজয় উদযাপন করতে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব এক বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে কালী পূজা শুরু করেন। এটি ছিল প্রথম বড় আকারের কালী পূজা, যা ব্রিটিশদের সঙ্গেও একটি রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রতীক ছিল। নবকৃষ্ণ দেব কালী পূজার মাধ্যমে বাংলার সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অধ্যায়ের সূচনা করেন।
নবকৃষ্ণ দেবের প্রবর্তিত এই কালী পূজা ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বাংলার উচ্চবিত্ত ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে দ্রুত প্রসার লাভ করে। এরপর থেকে কালী পূজা কলকাতা এবং অন্যান্য শহরে এক বড় উৎসবে পরিণত হয়। বিশেষত, কালীঘাট মন্দির ও দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে কালী পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় আকারে উদযাপিত হতে থাকে।
কালী পূজা ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের অবদান
১৯শ শতাব্দীতে কালী পূজার জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের মাধ্যমে। রামকৃষ্ণ ছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের পুরোহিত এবং তিনি দেবী কালীর একান্ত ভক্ত ছিলেন। তাঁর জীবন ও দর্শনের মূলভিত্তি ছিল কালী পূজা। তিনি দেবী কালীর সঙ্গে একটি গভীর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর উপাসনার মাধ্যমে কালী পূজা নতুনভাবে আলোচিত হয়।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর আদর্শ এবং কালী পূজার গুরুত্বকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন। এর ফলে কালী পূজা শুধু বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রামকৃষ্ণের সময় থেকে কালী পূজার আচার-অনুষ্ঠান, ভক্তি, এবং সামাজিক গুরুত্ব আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আধুনিক যুগে কালী পূজা
আজকের দিনে কালী পূজা বাংলার অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়। কলকাতা শহরে কালী পূজা দীপাবলির সঙ্গে মিলিত হয়ে এক বিশাল আকার ধারণ করে। হাজার হাজার পূজা মণ্ডপে দেবী কালীর পূজা করা হয়, এবং কোটি কোটি ভক্ত পূজার অংশগ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ওড়িশা, আসাম, এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও কালী পূজা মহাসমারোহে পালিত হয়।
আধুনিক সময়ে কালী পূজা শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনেরও এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কালী পূজার মাধ্যমে সমাজে একতা এবং শান্তির বার্তা পৌঁছে দেয়। এছাড়াও, পূজার সময়ে বিভিন্ন সঙ্গীত, নৃত্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, যা এই উৎসবকে আরও মহিমাময় করে তোলে।
কালী পূজার প্রভাব ও গুরুত্ব
কালী পূজার প্রভাব বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতির উপর গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত। দেবী কালী হিন্দু ধর্মে শক্তি, সময় এবং মৃত্যু প্রতীক, এবং তাঁর উপাসনার মাধ্যমে ভক্তরা জীবনের সকল অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য প্রার্থনা করেন। কালী পূজা কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি সমাজের মধ্যে এক ধরণের শক্তির সংহতি সৃষ্টি করে।
আজকের দিনে কালী পূজার মাধ্যমে মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণের উর্ধ্বে গিয়ে একত্রিত হন এবং দেবী কালীর আশীর্বাদ গ্রহণ করেন।
👉 আমাদের ফলো করুন:
📰 ট্রেন্ডিং খবর | 📢 জরুরি আপডেট | 💼 নতুন চাকরির সুযোগ
🟢 হোয়াটসঅ্যাপ | 🔵 টেলিগ্রাম
🔵 লিঙ্কডইন | 🔵 থ্রেড | 🔵 ফেসবুক | 🔵 ইনস্টাগ্রাম | 🔵 টাম্বলার
Discover more from
Subscribe to get the latest posts sent to your email.